গৃহে-কর্মক্ষেত্রে দয়ার সাংস্কৃতিক গড়ে উঠক
রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে শুরু করি। সে গান দয়ার গান। ‘দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে/ নইলে কি আর পারব তোমার চরণ ছুঁতে।’
আমরা আমাদের কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে স্রষ্টা পর্যন্ত সবারই দয়া চাই এবং কম-বেশি পাই। যতটুকু পাই, সন্তোষ না জানিয়ে আরো বেশি করে চাইতে থাকি:
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো দাও প্রাণ
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো দাও স্থান
আরো আলো আরো আলো
এই নয়নে প্রভু ঢালো।
ভবনেও চাই, ভুবনেও চাই, আমরা কেবল চাইব আর নেব, দেব না কিছুই? দয়া একটুও না?
অথচ দয়ার ভাষার চেয়ে অধিকতর বিশ্বজনীন আর কোনো ভাষা নেই। মার্ক টোয়াইন বলেছেন: বধির যে ভাষা শুনতে পায়, অন্ধ যে ভাষা দেখতে পায়, সে ভাষা দয়ার।
এই বিশ্বজনীন ভাষাটি তো আমাদের সবারই জানা। কিন্তু তার ব্যবহার বড্ড কম। দয়া কম বলেই গৃহকর্মী বালিকা জান্নাতির বেলায় কেবল শারীরিক অত্যাচারই যথেষ্ট মনে হয়নি, তাকে হত্যা করতে হয়; বিশ্বজিৎ নামের কর্মিষ্ঠ একটি তরুণকে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে খুন করা হয়; দয়া নেই বলেই উচ্চাশা ও স্বপ্ন নিয়ে দেশের একটি শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে আসা আবরারকে পৈশাচিক নির্মমতায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়; দয়া নেই বলেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তার ছাত্রীকে কেরোসিনে পুড়িয়ে মারার হুকুম দিতে পারেন… এ তালিকা শেষ হওয়ার নয়। আমাদের নির্মমতার ক্যাটালগ প্রতিদিনই ভারী হয়ে উঠছে। এ দুর্ভার ক্যাটালগের ভার বইবার শক্তি পৃথিবীর নেই।
দয়ার ভাষা কি খুব কঠিন?
মোটেও না। এর চেয়ে সহজ আর কোনো ভাষা নেই। এ ভাষার প্রথম প্রকাশ একটুখানি মিষ্টি হাসিতে। উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড কাজটাকে খুব সহজ করে দিয়েছেন: একটি উষ্ণ হাসিতে দয়ার বিশ্বভাষার শুরু।
আমাদের অনেকেরই প্রিয় চিত্রনায়িকা রোমান হলিডে কিংবা ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিজের অড্রে হেপবার্ন তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, আপনার সুন্দর ঠোঁট থেকে কী লাভ, যদি আপনার কথা মিষ্টি না হয়?
আপনার সুন্দর চোখ থেকে কী লাভ, যদি আপনি অন্যের জন্য ভালোটা দেখতে না পারেন?
আমাদের প্রায় সবারই শৈশবে পড়া ঈশপের গল্পগুলোর কথা মনে করুন—দয়ার ছড়াছড়ি, ছোট ছোট দয়া। ঈশপ নিজেই বলেছেন, যত ছোটই হোক কোনো দয়াই বিফলে যায় না।
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেছেন, ‘যে যেখানেই থাকুন, সামান্য একটু কেবল দয়া করুন, তাতেই পৃথিবীতে দয়ার বন্যা বয়ে যাবে।’
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথা তো বলতেই হয়: তরবারি চালিয়ে যা অর্জন করবেন তা কয়দিন টিকবে বলা যায় না, কিন্তু দয়া দিয়ে যে ভালোবাসা পাবেন তা টিকে থাকবেই।
ছোট ছোট দয়ার জাপানি আন্দোলনটির নাম ছিল ‘স্মল কাইন্ডনেস মুভমেন্ট’। অনেকদিন ধরেই তারা ছোট ছোট কাজ করে আসছিলেন, তারাই সমমনা আরো কিছু মানুষ নিয়ে তাদের আন্দোলনটি বৈশ্বিক করে তুলতে চাইলেন। উদ্যোগে সাড়া মিলল, ১৯৯৭ সালে সৃষ্টি হলো ওয়ার্ল্ড কাইন্ডনেস মুভমেন্ট। ১৯৯৮ সালে টোকিওতে অনুষ্ঠিত হলো তাদের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
শুরুর দিকে যে কয়টা দেশ সাড়া দেয়, তার মধ্যে জাপান ছাড়াও রয়েছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নাইজেরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
২০০৯ সালে সিঙ্গাপুর পালন করল বিশ্ব দয়া দিবস। ভারত ও ইতালিও পালন করল। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রও পিছিয়ে থাকল না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো বিশ্ব দয়া দিবস উদযাপনের সূচনা করছে।
এটা তো মিথ্যে নয়, দিনক্ষণ ঠিক করে দয়া প্রকাশ করা যায় না। তাহলে ১৩ নভেম্বরের এই উদযাপন কেন। কারণ একটিই, এদিনসহ ৩৬৫ দিনই যেন একটু একটু করে দয়া বর্ষণে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারি তা স্মরণ করিয়ে দেয়া। সদয় হওয়ার প্রতিশ্রুতিটি রক্ষা করব, অন্তত এটুকু আরেকবার বলা।
ঘরের মানুষের জন্য, বাইরের মানুষের জন্য, কর্মস্থলের মানুষের জন্য একটু একটু সদয় হলে দয়াবান মানুষটিরও কম লাভ নয়। ডাক্তার ডেভিড হ্যামিল্টনের গবেষণায় একটি অসাধারণ আবিষ্কার উঠে এসেছে: দয়ার কাজকর্মে যারা জড়িত, তাদের বার্ধক্য অন্যদের তুলনায় অনেক শ্লথগতিতে হয়।
তিনি আরো দেখিয়েছেন দয়ার কাজে মানুষটির মধ্যে ‘হেল্পার্স হাই’ সৃষ্টি হয়, তাতে শরীরে এন্ডোরফিন, ডোপামিন নিঃসরণ বেড়ে যায়। ফলে আগের চেয়ে বেশি সুখী অনুভব করে।
হিউম্যান জেনোমে কাইন্ডনেস জিনের অস্তিত্বের কথা কেউ কেউ বলেন। ডাক্তার হ্যামিল্টনের মতে, মানুষ যখন দয়ার কাজে নিজেকে যুক্ত করে, তার আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের নেটওয়ার্কটি বড় ও জোরদার হয়। দয়ার কাজ মানুষের অন্যান্য কার্যক্রমও বাড়িয়ে দিয়ে তাকে আরো সচল করে তোলে। এ কাজের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে এটি ছোঁয়াচে। একজন কেউ শুরু করলে তার বন্ধু-স্বজনসহ ১০ জন এসে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের গবেষক রিচার্ড ডেভিডসন দয়াগ্রহীতার লাভের বাইরেও দয়া প্রদানকারী ব্যক্তির তিনটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির প্রমাণ বের করেছেন:
প্রথমটি মানুষের এনার্জি লেভেল বৃদ্ধি; দ্বিতীয়টি পজিটিভ সূচক বৃদ্ধি (আশাবাদ বাড়বে, রক্তচাপ কমবে, হূদযন্ত্রের স্বাস্থ্য—কার্ডিওভাসকুলার হেলথ ভালো হবে); তৃতীয়টি দেহের অভ্যন্তরে ভালো লাগার নিঃসরণ ‘সেরোটোনিন’ বাড়ার কারণে সুস্থতা বেড়ে যাবে।
অন্য একটি মার্কিন সমীক্ষা দেখিয়েছে দয়ালু একজন সহকর্মী যেটুকু দয়া করেন, অন্য একটি কন্ট্রোল গ্রুপের তুলনায় নিজের সহকর্মীদের থেকে ২৭৮ গুণ বেশি দয়া পেয়ে থাকেন।
আমরা স্লিমিং ডায়েট চার্ট কিনতে বাজারে ছুটি, ভুঁড়ি কমাতে, বিবর্ধক ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট করতে, ম্যানিকিউর-পেডিকিউর করতে মাসের আয় তুলে দিই অন্যের হাতে, কিন্তু কেমন করে দয়া দেখাব এ টিপস নিতে কোথাও যাই না।
তুই-তোকারি করতে ভালোবাসি, নিজের নিরাপত্তাহীনতা নিজেই সৃষ্টি করে ঘাতক পরিবেষ্টিত থাকি, মিথ্যের সঙ্গে মিতালি পাতাই, অধঃস্তন সহকর্মীর সঙ্গে সামন্ত প্রভুর আচরণ করি, ধন্যবাদ দিই না, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি না, শত মিথ্যে দিয়ে সত্যকে ঢেকে ফেলি।
লোক দেখানো, হাততালি বাগানো কাজ দয়া নয়; অন্য কিছু—সম্ভবত প্রতারণা, প্রথমত জনগণের সঙ্গে, দ্বিতীয়ত নিজের সঙ্গে। এ প্রতারণা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে সম্মান করতে হবে—এটাই সবচেয়ে বড় কাইন্ডনেস, সবচেয়ে বড় দয়া। সম্মানই সৃষ্টি করে এমপ্যাথি—সহমর্মিতা। প্রত্যাশা করতে পারি ‘বিশ্ব দয়া দিবস’ বাংলাদেশেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবে, গৃহে ও কর্মক্ষেত্রে দয়ার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হবে: আমার বাড়ির সবাই আমাকে ভয় পায় কিংবা আমার অফিসে সবাই আমার ভয়ে থরথর করে কাঁপে—এটি মোটেও ভালো কোনো স্টেটমেন্ট নয়। এটা বলে দেয় আপনার ঘরে অশান্তিই বেশি, আপনার অফিসের উৎপাদনশীলতা কম। এ আতঙ্ক বিস্তারের প্রতিষেধকই হচ্ছে দয়া।
অজ্ঞাত এক মনীষীর কথাটি স্মরণ করি: আপনার দয়া হচ্ছে সূর্যালোক, শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে তা সবাইকে আলোকিত করে।
টীকা: ইংরেজি শব্দ কাইন্ডনেসের মানে সহূদয়তা, উদারতা ভালো শোনায়। কাইন্ড মানে দয়ালু। দয়ালু ব্যক্তির গুণটির নাম দয়া, সেটিই কাইন্ডনেস। ব্যবহারিক কারণে ‘পিটি’ মানেও দয়ায় পরিণত হয়েছে। আমরা দয়াকে কাইন্ডনেসে ফিরিয়ে নিতে চাই।
আন্দালিব রাশদী: কথাসাহিত্যিক