নবাববাড়ির খাস খাবার

নকশার পাঠকদের জন্য লক্ষ্ণৌর নবাববাড়ির খাবার রাঁধলেন লক্ষ্ণৌর শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের চতুর্থ বংশধর বেগম মঞ্জিলাত ফাতিমা। কৃতজ্ঞতা: কারি অ্যাসেন্ট, ছবি: খালেদ সরকার

নকশার পাঠকদের জন্য লক্ষ্ণৌর নবাববাড়ির খাবার রাঁধলেন লক্ষ্ণৌর শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের চতুর্থ বংশধর বেগম মঞ্জিলাত ফাতিমা। কৃতজ্ঞতা: কারি অ্যাসেন্ট, ছবি: খালেদ সরকারভারতের লক্ষ্ণৌর শেষ নবাব ছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ, নবাবি চলে যাওয়ার পর ১৯৫৬ সাল থেকে যিনি কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। নতুন শহরে নবাব পরিবারের রেশ থেকে যায় ওয়াজিদ আলি শাহের অন্দরে ও বাইরে। আউধের (লক্ষ্ণৌ) নবাববাড়ির খাবারের খ্যাতি তো আর এক দিনের না। নানা রকম খাবারের জন্ম হয়েছে এই বাড়ির হেঁশেলে। বিরিয়ানি, কাবাব, ফিরনি বা হালুয়া—নবাববাড়ি থেকে যেসব খাবারের উৎপত্তি, তা এখন আমাদের ঘরে ঘরে তৈরি হয়। যেটা খেয়ে ‘উহু আহা’ করি আমরা। তবে সেসব স্বাদ পুরোপুরি পেলে না–জানি কতটা আপ্লুত হতেন খাবারপ্রেমীরা।

তবে আউধের নবাবি খাবারের আসল স্বাদ এখনো টিকে আছে বংশপরম্পরায়। ওয়াজিদ আলি শাহের চতুর্থ বংশধর হিসেবে নবাববাড়ির খাবার প্রকাশ্যে এনেছেন বেগম মঞ্জিলাত ফাতিমা। সম্প্রতি ঢাকার গুলশানে কারি অ্যাসেন্ট রেস্তোরাঁর আমন্ত্রণে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। সেখানে সাত দিন ধরে চলা আউয়াধি ফুড ফেস্টিভ্যালে নিজেই রান্না করেছেন নবাবি খাবার। ব্যস্ত সময়ের ফাঁকে সময় দিয়েছেন নকশার জন্যও। রান্না করেছেন নবাবি খাবারের কয়েক পদ, দিয়েছেন রেসিপিও। 

মঞ্জিলাত ফাতিমা রান্না শিখেছেন তাঁর মায়ের কাছে। মঞ্জিলাতের বয়স যখন পাঁচ বা ছয় বছর, তখন মারা যান তাঁর দাদি। তাই দাদির হাতের রান্নার স্বাদ তাঁর খুব একটা মনে নেই। নবাববাড়ির হেঁশেল থেকে যত খাবারের জন্ম হয়েছে, তার পেছনের গল্পগুলোও চমৎকার। মঞ্জিলাত ফাতিমা গল্প বলতে থাকেন, কাবাব খুব ভালোবাসতেন নবাবেরা। তাই নানা রকম কাবাবের প্রচলন হতে থাকে। এই যেমন গালুটি কাবাব। 

এটা এত মিহি আর নরম হয় যে মুখে পুরে দিলেই হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মিলিয়ে যেতে থাকে। নবাববাড়ির বয়স্ক লোকদের যখন সব দাঁত পড়ে যেত, তখনো যাতে তাঁরা কাবারের স্বাদ নিতে পারেন, তাই গালুটি কাবাবের জন্ম।

এমন আরও নানা ঘটনা বলতে থাকেন মঞ্জিলাত। সারা ভারতে নানা রকম বিরিয়ানির প্রচলন থাকলেও বিরিয়ানিতে আলু দেওয়ার প্রচলন কলকাতা থেকেই। সেটাও এই নবাববাড়ির রান্নাঘরে। তখন সবেমাত্র পর্তুগিজ থেকে নতুন ধরনের সবজি হিসেবে আলু ভারতে আসতে শুরু করেছে, যা কেবল অভিজাত এলাকার বাজারেই মেলে। সেটা নিয়ে নিরীক্ষা করলেন ওয়াজিদ আলি শাহের বাবুর্চিরা। বানালেন মাংসের সঙ্গে আলুযুক্ত বিরিয়ানি। নতুন এই স্বাদের আরেকবার বাহবা পড়ল শহরজুড়ে। অতিথি আপ্যায়নে নতুন এই স্বাদ সুনাম বাড়াল নবাবি রান্নার। 

মঞ্জিলাত বলেন, ‘এসব গল্প তো বলে শেষ করার নয়। খাবার তৈরিতে নানা রকম মসলা, খাঁটি ঘি, জাফরান, তবক, গোলাপের পাপড়ি, সুগন্ধি চাল, শুকনো ফলমূল, গোলাপ জল—কত কী ব্যবহৃত হয়! নিজেও সেভাবে রান্না করতে চেষ্টা করি। যে খাবারে যে যে উপকরণ দরকার, তাতে কোনো ছাড় দেওয়া উচিত নয়। এমনকি পরিবেশনেও না। আমি এখনো আশুরার দিনে (১০ মহররম) কাবাবসহ নানা রকম যে খাবার বিতরণ করি, সেটা বড় তবকে সাজিয়ে ওপরে কাপড় দিয়ে দুই হাতে ওপরে তুলে নিয়ে যেতে হয়।’

রান্না নিখুঁত করার ব্যাপারে মঞ্জিলাতের চেষ্টা দেখলেও বোঝা যায় খাবার নিয়ে তাঁদের আবেগ কতটা। নকশার জন্য রান্নার পর পরিবেশনের জন্য একই খাবারে ডিশ বদলালেন কয়েকবার। ক্ষিরের ওপর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে সেটাও নিখুঁত করলেন কয়েকবার ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে। নবাবি খাবারের প্রতি ভালোবাসা থেকেই মঞ্জিলাত কলকাতার কসবায় গড়েছেন মঞ্জিলাত নামে একটি রেস্তোরাঁ, যেখানে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ান মঞ্জিলাত।

মঞ্জিলাত ফাতিমার দেওয়া নবাবি খাবারের রেসিপি—

শাহি ক্ষীর

উপকরণ: চিনি গুঁড়া চাল ৫০ গ্রাম (২ ঘণ্টা ভেজানো এবং গুঁড়া করা, তবে মিহি গুঁড়া নয়), দুধ ২ লিটার (ফুটানোর জন্য), চিনি ৭৫ গ্রাম (অথবা স্বাদমতো), সবুজ এলাচিগুঁড়া আধা চা-চামচ, গোলাপজল ১ চা-চামচ, কিশমিশ ১ টেবিল চামচ, চিরঞ্জি (তরমুজের সাদা বীজ) অথবা কাজু বাদাম ১ টেবিল চামচ, কিছু গোলাপের পাপড়ি ও তবক সাজানোর জন্য।
প্রণালি: দুধ ফুটিয়ে নিন, ফুটন্ত দুধে গুঁড়া করা চাল যোগ করুন। ক্রমাগত নাড়তে থাকুন, যাতে জমাট বেঁধে না যায়। মিশ্রণটা ঘন হয়ে এলে এবং চাল সেদ্ধ হয়ে গেলে চিনি যোগ করুন। চিনি গলে যাওয়া পর্যন্ত নাড়তে থাকুন। চিরঞ্জি ও কিশমিশ যোগ করুন। একটি পাত্রে ঢেলে নিয়ে ঠান্ডা করুন। তবক, চিরঞ্জি ও গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজিয়ে নিন। পছন্দমতো ঠান্ডা বা গরম পরিবেশন করুন।

মাটন গালাওয়াতি

190917khaled-Sarker0112

উপকরণ: খাসির মাংসের কিমা ১ কেজি, কাঁচা পেঁপেবাটা ২০০ গ্রাম, আদা–রসুনবাটা ২ টেবিল চামচ, কাজুবাটা ১ টেবিল চামচ, পোস্তবাটা ১ টেবিল চামচ, ভাজা পেঁয়াজবাটা ২ টেবিল চামচ, গরমমসলার গুঁড়া ২ টেবিল চামচ, এলাচি–লবঙ্গ–দারুচিনি–জায়ফল–জয়ত্রী–কাবাব চিনি একসঙ্গে মিহি গুঁড়া করা, দই ১ টেবিল চামচ, লাল মরিচগুঁড়া ২-৩ চা–চামচ, ভাজা ছোলার বেসন, কেওড়াজল ৩-৪ চা চামচ ও লবণ স্বাদমতো।
প্রণালি: সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে ম্যারিনেট করে ৪-৫ ঘণ্টা রাখুন। এরপর এই ম্যারিনেট করা মিশ্রণের ঠিক মাঝ বরাবর কয়লার একটি ছোট বাটি রেখে ধোঁয়া করুন। খানিকটা ঘি ঢেলে সঙ্গে সঙ্গে ঢেকে ফেলুন। আরও ১০-১৫ মিনিট রাখুন। মৃদু তাপে ননস্টিক প্যানে কাবাব করুন। সবুজ চাটনির সঙ্গে পরিবেশন করুন।

জাফরানি সবজি কাবাব

190917khaled-Sarker0051

উপকরণ: মুলা ৪০০ গ্রাম, বেসন ৬০ গ্রাম, এলাচি ৫টি, লবঙ্গ ৫টি, দারুচিনির গুঁড়া আধা চা-চামচ, কালিজিরা ২ চা-চামচ, পোস্তদানা ৩ চা-চামচ, নারকেলকুচি ৬০ গ্রাম, দই ৩ চা-চামচ, ব্রেড ক্রাম্ব সিকি কাপ, পেঁয়াজ বেরেস্তা ৬০ গ্রাম (পেঁয়াজ ঘিয়ে ভেজে গুঁড়া করা), জাফরান ১ চিমটি, তেল ভাজার জন্য ও লবণ স্বাদমতো।
প্রণালি: মুলার পাতা ও গোড়ার দিক কেটে ফেলুন, কাঁটা চামচের সাহায্যে ছিদ্র করুন। এরপর লবণ পানিতে ২০ মিনিট সেদ্ধ করুন। ঝাঁজরিতে রেখে দিন, পানি ঝরতে থাকবে ও ঠান্ডা হবে। এর মধ্যে সব শুকনা মসলা গুঁড়া করে নিন এবং বেসন ভুনে নিন। সব শুকনো উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে নিন। মুলা ঠান্ডা হয়ে এলে ও পানি ঝরে গেলে চূর্ণ করে নিন (সূক্ষ্মভাবে নয়)। সব উপকরণ মিশিয়ে নিন। মিশ্রণটা পানি পানি হয়ে গেলে (মুলায় পানির পরিমাণ বেশি থাকলে এ রকম হতে পারে) আরও ব্রেড ক্রাম্ব যোগ করুন। কাবাবের আকৃতি তৈরি করে তেলে ভাজুন। ধনেপাতা, কাঁচা মরিচ ও নারকেলকুচি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

পনির রেজালা

190917khaled-Sarker0067

উপকরণ: দুধ আধা লিটার, দই ১০০ গ্রাম, কাজুবাটা আধা টেবিল চামচ, পোস্তবাটা আধা টেবিল চামচ, ময়দা ২ চা-চামচ, সয়াবিন তেল ৫০ মিলিলিটার (যে কোনো স্বচ্ছ তেল হলেও চলবে), পনির ২০০ গ্রাম, আদা–রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, পেঁয়াজবাটা ২ টেবিল চামচ, দারুচিনি ৩টি, এলাচি ৩টি, লবঙ্গ ৩টি, গরমমসলার গুঁড়া দেড় চা-চামচ, মিষ্টি আতর কয়েক ফোঁটা ও কেওড়াজল ১ টেবিল চামচ।
প্রণালি: একটি হাঁড়িতে ১ টেবিল চামচ তেল ঢালুন। গোটা গরমমসলা দিয়ে নাড়তে হবে। পেঁয়াজবাটা দিন। দ্রুত নাড়তে থাকুন এবং আদা–রসুনবাটা যোগ করুন। সাদা ও স্বচ্ছ না হওয়া পর্যন্ত নাড়াচাড়া করতে হবে। এবার পনির দিয়ে দ্রুত নাড়ুন এবং রেখে দিন। অন্য একটি পাত্রে ১ টেবিল চামচ তেল ও ময়দা দিয়ে কয়েক মিনিট নাড়ুন। ধীরে ধীরে এতে ফেটানো দই ও সবটুকু দুধ যোগ করুন (যেন জমাট বেঁধে না যায়)। ধীরে ধীরে দুধ ফুটে উঠলে কাজু ও পোস্তবাটা দিন। কিছুক্ষণ রান্না হবে। এরপর মিষ্টি আতর, গরমমসলার গুঁড়া ও কেওড়াজল দিন। স্বাদমতো লবণ দিন। আগে থেকে রান্না করে রাখা পনির যোগ করুন এই মিশ্রণে (অথবা একই পদ্ধতিতে মুরগি বা খাসির মাংস দিতে পারেন)। ঝোলের ঘনত্ব মনমতো করে নিন। তেল ভেসে না ওঠা পর্যন্ত চুলায় রাখুন। তন্দুর রুটি, নান বা রুমালি রুটি দিয়ে পরিবেশন করুন।

দম বিরিয়ানি 

190917khaled-Sarker0095

উপকরণ: সরিষার তেল ১০০ মিলিলিটার, দারুচিনি–লবঙ্গ–এলাচি ৩-৪টি করে, পেঁয়াজ মাঝারি আকারের ২টি (চপ করা), হলুদগুঁড়া সিকি চা-চামচ, লাল মরিচের গুঁড়া আধা চা-চামচ, ধনেগুঁড়া আধা চা-চামচ, গরমমসলার গুঁড়া ২ চা-চামচ, দই ১ টেবিল চামচ ও লবণ স্বাদমতো।
প্রণালি: একটি পাত্রে সরিষার তেল গরম করুন। দারুচিনি, লবঙ্গ ও এলাচি দিন। শব্দ হতে শুরু করলে পেঁয়াজকুচি যোগ করুন। নরম ও স্বচ্ছ না হওয়া পর্যন্ত নাড়তে থাকুন। এরপর ১ চা–চামচ করে রসুনবাটা, হলুদগুঁড়া, লাল মরিচের গুঁড়া, ধনেগুঁড়া, গরম মসলাগুঁড়া এবং ১ টেবিল চামচ দই যোগ করুন। স্বাদমতো লবণ দিন। হালকাভাবে নাড়ুন। খাসির মাংস দিন (প্রেশার কুকারে ১২ মিনিট ভুনা করুন, প্রথম হুইসেলের পর আঁচ মৃদু করে দিন)। চাইলে মাংস রান্নার সময় মাইক্রোওয়েভ ওভেনে আলুও রান্না করে নিয়ে এ সময় এই পাত্রে যোগ করতে পারেন। লবণপানিতে চাল সেদ্ধ করুন (তিন–চতুর্থাংশ সেদ্ধ, তেজপাতা, এলাচি, লবঙ্গসহ)। ছেঁকে নেওয়ার পর এক কাপ মাড় রেখে দিন। আরেকটি পাত্রে রান্না করা মাংস ঢেলে নিয়ে বিরিয়ানির নিচের স্তরটি সাজিয়ে নিন এরপর এর ওপর ভাত ছড়িয়ে দিন। এর ওপর ভাতের মাড়, কেওড়া জল এবং ২ টেবিল চামচ খাঁটি ঘি ছড়িয়ে দিন। ১৫-২০ মিনিট দমে রেখে এরপর নামাতে হবে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seo