পঞ্চমে বাঁধা সুর

দুটি গন্ধ বাঙালি ভুলতে বসেছে। প্রথমটি ইলিশের গন্ধ। দ্বিতীয়টি কুইজ হিসেবে থাক শুরুতে।

এই মেট্রোপলিটন শহরে বসতি গেড়েছি এক যুগের ওপর। যে এলাকায় থাকি, হলফ করে বলতে পারি, গত এক যুগে এই এলাকায় খুব কম পেয়েছি সে গন্ধ। তার চেয়ে বরং পিচবাঁধানো গোড়া নিয়ে ধুঁকতে থাকা শিউলিগাছটি প্রতিবছর নিয়ম করে শরতে ফুল দিয়েছে। গল্প শুনেছিলাম ঠাকুরমার কাছে, ডাল রান্নার সময় পাঁচ বাড়ি পর থেকে হাঁচির শব্দ না পেলে তিনি ভাবতেন, ডাল আজ ‘বনলো’ না। দ্বিতীয় গন্ধের নাম পেয়ে গেছেন, তাই তো? হ্যাঁ, ইলিশের গন্ধের মতো বাঙালির জীবন থেকে ফোড়নের গন্ধ উবে গেছে কর্পূরের মতো। এই শহর জীবনে হঠাৎ পাওয়া যায় ফোড়নের কড়া গন্ধ। অথচ একসময় এই গন্ধ থেকে অভিজ্ঞ মানুষ বুঝে নিতেন কার বাড়িতে কোনো ডাল রান্না হচ্ছে।

ফোড়ন ছাড়া ডাল আর মাংস ছাড়া বিরিয়ানি, ফোড়ন ছাড়া পাঁচমিশালি সবজির ঘন্ট আর কপালে টিপ ছাড়া বাঙালি সুন্দরী, ফোড়ন ছাড়া রুই মাছের পাতলা ঝোল আর প্রেমহীন পুরুষ, ফোড়ন ছাড়া শিং-মাগুরের ঝোল আর জল ছাড়া নদী, একই বস্তু। ফোড়ন ছাড়া এসব রান্না হবে না, তা বলছি না। বলছি, রান্নাবান্নায় বাঙালি শত শত বছর ধরে যে শাস্ত্র তৈরি করেছে গ্রহণ-বর্জন আর আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে, সেই শাস্ত্রে লেখা আছে, ফোড়ন ছাড়া এসব হয় না। আর সে জন্যই ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ফোড়ন এক রকম। কিন্তু বাঙালির ফোড়ন পঞ্চমে বাঁধা। জিরা, মৌরি, মেথি, কালোজিরা এবং কালো সরিষা—এই পঞ্চপাণ্ডব হলো বাঙালির আদি ফোড়ন, যাদের আমরা একনামে চিনি পাঁচফোড়ন হিসেবে। তবে আমরা জাতে বাঙালি তো, তাই এখানেও একটা ‘বঙ্গীয় ব্যতিক্রম’ তৈরি করেছি। কালো সরিষার বদলে রাঁধুনি, ধনে বা রাই সরিষা জায়গা করে নিয়েছে আমাদের পাঁচফোড়নে। ব্যাপারটা যে খুব খারাপ হয়েছে, তা নয়। গন্ধ ও স্বাদের বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্ন রকম হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন, পাঁচফোড়নের মূল পাঁচটি উপাদান আসলে দানা বা বীজ। শুধু যখন আপনি রাঁধুনি যোগ করবেন তখন বীজের সঙ্গে ফল যোগ হবে। কারণ, রাঁধুনি বীজ নয়, ফল। পাঁচফোড়নের সঙ্গীসাথিও আছে। বেশির ভাগ সময় গরম পাঁচফোড়নে তেজপাতা, মরিচ, রসুন ও পেঁয়াজ দেওয়া হয়। তবে নিরামিষ তরকারিতে অবশ্যই রসুন-পেঁয়াজ বাদ যাবে।

ছবি: নকশা

ছবি: নকশাপ্রেমের অনুভূতি যেমন কাউকে শিখিয়ে দেওয়া যায় না তেমনি পাঁচফোড়নের ব্যবহার আর কথায় কথায় ফোড়ন কেটে অন্যের জীবন ঝাঁজিয়ে তোলার বিদ্যা বাঙালিকে শেখানো বাতুলতা মাত্র। তবে যারা নতুন রাঁধুনি তাদের জন্য বলি, গরম কড়াইয়ে পরিমাণমতো তেল গরম করে তাতে পরিমাণমতো পাঁচফোড়ন দিয়ে দিন। তারপর আগে থেকে সেদ্ধ করে রাখা ডাল কিংবা কেটে রাখা সবজি দিয়ে ঢেকে দিন। তেল যত গরম হবে, পাঁচফোড়নের ঝাঁজও ততই কড়া হবে। আর যদি পাঁচফোড়ন ব্যবহার করেন গরম সরিষার তেলে, তাহলে পাঁচ বাড়ি দূর থেকে হাঁচির শব্দ পাবেন। তবে একটা তথ্য আমাদের মনে রাখতে হবে, বাঙালি একসময় তেলের চেয়ে ঘি বেশি ব্যবহার করত। ফলে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোতে দেখবেন তেলের চেয়ে ঘির কথা বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। কখনো কখনো, বিশেষ করে আমিষ রান্নার সময় ‘কটু তেল’ মানে সরিষার তেলের উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য সব অভিধানে ফোড়ন বিষয়ে বলা হয়েছে, তেলে বা ঘিয়ে ভাজা। বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত পাঁচফোড়ন পাবেন সুপারশপে বা বাজারে। তা ছাড়া আপনি নিজেও বাজার থেকে পাঁচটি উপাদান আলাদা কিনে এনে বাড়িতেও তৈরি করতে পারেন এটি। পাঁচটি উপাদানের পরিমাণ কেমন হতে পারে তার একটা ধারণা নেওয়া যাক-২ টেবিল চামচ জিরা, ১ চা-চামচ মৌরি, আধা চা–চামচ কালো জিরা, ১ চা-চামচ কালো সরিষা, ১ চা-চামচ মেথি। এর সঙ্গে চাইলে ২ টেবিল চামচ ধনে কিংবা ২ চা-চামচ রাঁধুনিও মিশিয়ে দিতে পারেন আপনি। পরিমাণ এদিক–সেদিক হলে এমন কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।

পাঁচফোড়নের প্রতিটি উপাদান ভেষজ গুণে ভরপুর। এসব গুণের কারণেই হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষেরা খাবার তৈরির উপকরণ হিসেবে পাঁচফোড়নের ব্যবহার অনুমোদন করেছিলেন। বাঙালি রান্নার ঐতিহ্যের জন্য নয়, স্বাদের জন্যই পাঁচফোড়নের বাগার বা সম্বরা দেওয়া তরকারি খান নিয়মিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seo