শরীরে রক্তস্বল্পতা কী এবং কখন হয়?

রক্তস্বল্পতার লক্ষণ কী?

আমাদের হিমোগ্লোবিনের প্রধান কাজ হলো সে অক্সিজেনকে বহন করে। অক্সিজেন হলো আমাদের চালিকাশক্তি। আমরা যে কথা বলছি, কাজ করছি, নড়াচড়া করছি সবকিছুর জন্য কিন্তু অক্সিজেন দরকার। যখন আমার হিমোগ্লোবিন কমে যাবে, তখন অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা কমে যাবে।

তার মানে আমার শরীরে কিন্তু এর ধারাবাহিকতা রয়ে যাবে। হিমোগ্লোবিন কমে গেলে প্রথম হবে দুর্বলতা। কাজ করতে পারব না, সহজে অবসাদ হয়ে যাব, ক্লান্ত বোধ করব, আমি যখন সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উঠব, তখন কিছুক্ষণ পরপরই আমার বুক ধড়ফড় করবে। হেঁটে উঠতে পারব না। বুক ধড়ফড় করতে থাকবে। মস্তিষ্কের অবসাদ হবে। রক্তস্বল্পতার ক্ষেত্রে এগুলো আমরা পাব।

রক্তস্বল্পতা কীভাবে বোঝা যাবে?

প্রথমে আমরা ক্লিনিক্যালই দেখার চেষ্টা করি। যখন দুর্ঘটনা ঘটল, তখন অনেক রক্ত চলে গেল। সেটি তো এমনিতেই বোঝা যায়। অথবা লিভারের কারণে পায়খানার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে রক্ত চলে গেল। একে লিভার সিরোসিস বলি। এটা কিন্তু আমরা জানি। প্রথমে আমরা ইতিহাস নেওয়ার চেষ্টা করি। জানতে চাই, আপনার কোনো রক্তস্বল্পতার ইতিহাস রয়েছে কি না। পরে আমরা তার ইতিহাস নেব খাদ্যাভ্যাসের। আয়রনসমৃদ্ধ খাবার রোগী খাচ্ছে কি না, সেগুলো জানতে চাওয়া হয়।

রক্তস্বল্পতা হয়েছে, কখন বলবেন?

রক্তস্বল্পতা একটি প্রচলিত সমস্যা। অনেকেই এ সমস্যায় ভোগেন। সাধারণত আয়রনের ঘাটতি, দুর্ঘটনা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে রক্তস্বল্পতা হয়। শরীর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, অবসাদ, দুর্বলতা ইত্যাদি রক্তস্বল্পতার লক্ষণ। আমরা যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞার দিকে চলে যাই, বলা হয়, ছেলেদের যদি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা তেরোর নিচে চলে যায়, আর মেয়েদের যদি এটি বারোর নিচে চলে যায়, তখনই আমরা একে রক্তস্বল্পতা বলব।

রক্তস্বল্পতা কোন বয়সে হয়?

ইমিউনো কিছু বিষয় রয়েছে, যেকোনো বয়সে হতে পারে। আমাদের যখন বৃদ্ধি বেশি থাকে অথবা একজন মা যখন গর্ভধারণ করেন অথবা একটি মেয়ে যখন ঋতুস্রাবের পর্যায়ে থাকে, তখন রক্তস্বল্পতার সমস্যা হতে পারে। এই অভাবগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। তাহলে আমাদের সব ইতিহাস নিতে হবে। এরপর চলে যাব আমরা পরীক্ষায়। রক্তস্বল্পতা হলে শরীরটা সাদা, ফ্যাকাসে হয়ে যাবে। যখন কোনো রোগী সাদা হয়ে যেতে থাকে, তখন এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ সংকেত। আয়রনের অভাবে রক্তস্বল্পতা হলে জিহ্বাটা সমান হয়ে যায়। রোগী খাওয়ার সময় বলবে আমার ঝাল লাগে। ভিটামিন বি১২-এর অভাব হলে লাল টকটকে হয়ে যায়। মুখের কোনায় কোনায় ঘা হতে পারে। এরপর দেখব যে নখগুলো পাতলা হয়ে যাচ্ছে। আঙুল দিয়ে একটু চাপ দিলে দেখব নখ ভেঙ্গে যাচ্ছে। আঙুলগুলো চামচের মতো হয়ে যায়। আবার রক্তস্বল্পতা অনেক সময় ক্যানসারের কারণ হতে পারে। তাই আমাকে হাত দিয়ে দেখতে হবে, পেটে কোনো চাকা বা কিছু রয়েছে কি না। পরীক্ষার ক্ষেত্রে আমরা সিবিসি করব, পেরিফেরাল ব্লাড রেট করব। এগুলো করে আমরা তাকে পরীক্ষা করব, সে অনুযায়ী চিকিৎসা করব।

কী কী ধরনের রক্তস্বল্পতা রয়েছে। এর পেছনের কারণ কী?

আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তস্বল্পতা হতে পারে। আরেকটি হলো বোনমেরুগত কারণ। আমার রক্ত তৈরি হচ্ছে বোনমেরুতে। বোনমেরুর যেখানে রক্ত তৈরি হচ্ছে, সেখানে যদি কোনো কারণে ত্রুটি হয়, তাহলে সমস্যা হতে পারে। আর রক্ত তৈরি করতে গেলে আমার কতগুলো পুষ্টি দরকার। যদি কোনো একটি বিষয়ে আমার কোনো অভাব হয়, তাহলে এমন হতে পারে। বাইরে থেকে কোনো কারণে যদি বোনমেরুর মধ্যে সমস্যা হয়ে যায়, তাহলে সমস্যা হয়। যেমন হতে পারে ক্যানসার, অথবা হতে পারে ফাইব্রয়েড টিস্যুর সমস্যা, মাইক্রোফাইব্রোসিস। এই জাতীয় কোনো রোগ যদি হয় তাহলে সমস্যা হয়। বোনমেরু যদি কোনো কারণে সারপ্রেস হয়ে যায়, তাহলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।

কিছু কিছু জিনিস আয়রন শোষণকে কমিয়ে দেয়। তাহলে আপনি এমন কিছু খাচ্ছেন কি না যে আয়রন শোষণ কমে যাচ্ছে?

আমাদের বাংলাদেশে সবারই একটি বদ অভ্যাস, আমরা বেশি গ্যাসট্রিকের ওষুধ খাই। গ্যাসট্রিকের সমস্যা হলেও খাই, না হলেও খাই। আয়রন শোষণ করতে গেলে এসিড লাগবেই। আমি যখন এই গ্যাসট্রিকের ওষুধগুলো খাচ্ছি, তখন এই এসিড কমে যাচ্ছে। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। আয়রন কিন্তু আমার শোষণ হচ্ছে না। আমার কিন্তু রক্তশূন্যতা দেখা দিচ্ছে। তাহলে যে রোগীরা নিয়মিত গ্যাসট্রিকের ওষুধ খাচ্ছে, তাদের এগুলো দেখা দেবে। পাশাপাশি আমরা কথা কথায় মুড়ি-মুড়কির মতো অ্যান্টাসিড খেয়ে ফেলি। এটিও আয়রন শোষণে বাধা দেয়।

আমরা একটু কোমরে ব্যথা, পিঠে ব্যথা, কথায় কথায় ব্যথার ওষুধ খেতে থাকি। ব্যথার ওষুধ খেলে পাকস্থলীর ভেতর ঘা তৈরি হয়। সেখান থেকে রক্ত যায়। এটি ক্ষুদ্রান্ত্রেও কিছুটা সমস্যা করে। ডিওডেনামের প্রথম ভাগে গিয়ে আয়রন শোষণ হয়। আরেকটি পুষ্টির মধ্যে বলি ভিটামিন বি১২। ভিটামিন বি১২ থাকে সাধারণত লাল মাংস, মাছ, দুধ অথবা ডিমের কুসুমের মধ্যে। সাধারণত আমরা কমবেশি সবাই খাই। তাহলে আমি ইতিহাস থেকে এটি পেয়ে যাচ্ছি। আমাকে খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসটা নিতে হবে।

আরেকটি জিনিস আমরা বলি যে ফলিকের অভাব। এটি একটি প্রচলিত সমস্যা। অনেক বাচ্চার মধ্যে দেখা যায়, তারা ফাস্টফুড খাচ্ছে, পোলাও খাচ্ছে, মাংস খাচ্ছে। তারা কিন্তু শাকসবজি খেতে চায় না। সবুজ শাকসবজি না খেলে কিন্তু আপনি ফলিক এসিড পাচ্ছেন না। ভিটামিন বি১২ লিভারের তিন বছর পর্যন্ত সংগৃহীত থাকতে পারে। তবে ফলিক এসিড থাকে না। তাই ফলিক এসিড না খেলে সমস্যা দেখা দেবে। তাহলে এ ক্ষেত্রে আমার ইতিহাস দরকার।

এখন আমরা করব কি, পরীক্ষা করে দেখব। ভিটামিন বি১২-এর অভাব হলে দেখা যায় নার্ভের ওপর তার কিছুটা প্রভাব পড়ে। হাঁটাতে একটু দুর্বলতা দেখা দেয়। চোখে কিছু সমস্যা হয়, স্মৃতিতে সমস্যা হয়, যাকে বলি ডিমেনশিয়া। কিছু নিউরোলজিক্যাল ক্ষতি হয়ে যায়। এগুলো অনেক সময় স্থায়ী হয়ে যায়। তার মানে এই জিনিসগুলো আমার খেয়াল করতে হবে।

ডা. মো. আবুল কালাম আজাদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seo